বর্তমান বিশ্বে অনলাইনে তথ্যপ্রবাহ যত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে, তত দ্রুতই বাড়ছে গুজব ও ভুয়া তথ্যের বিস্তার। এই বিভ্রান্তিকর তথ্য কখনও অনিচ্ছাকৃত, আবার কখনও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হয়। তথ্য যাচাইয়ের অভাবে এসব গুজব সমাজে বিভ্রান্তি, সহিংসতা ও মতাদর্শিক বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো:

১.ডিসইনফরমেশন (Disinformation)

উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোকে ডিসইনফরমেশন বলা হয়। এর পেছনে সাধারণত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা আদর্শিক স্বার্থ জড়িত থাকে। যারা এই তথ্য ছড়ায়, তারা জানে এটি মিথ্যা — উদ্দেশ্য থাকে মানুষের মতামত প্রভাবিত করা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।

২.মিসইনফরমেশন (Misinformation)

মিসইনফরমেশন হলো অনিচ্ছাকৃত ভুল তথ্য প্রচার। একজন ব্যক্তি ভুলভাবে কোনো তথ্য বিশ্বাস করে বা যাচাই না করেই তা শেয়ার করে ফেলেন, যদিও তার উদ্দেশ্য বিভ্রান্তি ছড়ানো নয়।

কীভাবে যাচাই করবেন তথ্যটি সত্য, মিথ্যা না গুজব?

‌১. তথ্যের উৎস যাচাই করুন

  • তথ্যটি কোথা থেকে এসেছে?

  • সোর্সটি বিশ্বস্ত কি না খতিয়ে দেখুন — এটি কোনো সরকারি সংস্থা, নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা যাচাইকৃত সোশ্যাল মিডিয়া পেজ কিনা।

  • সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোফাইল বা পেইজটি কতদিন ধরে সক্রিয়, আগেও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে কিনা, তা লক্ষ্য করুন।

২. বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যমে অনুসন্ধান করুন

  • গুগল বা গুগল নিউজে সার্চ করে দেখুন তথ্যটি কোন কোন সংবাদমাধ্যমে এসেছে।

  • শুধুমাত্র একটি সূত্রের উপর নির্ভর না করে একাধিক উৎসের সাথে মিলিয়ে দেখুন।

৩. রিভার্স ইমেজ ও ভিডিও সার্চ ব্যবহার করুন

  • Google Lens, TinEye অথবা Yandex ব্যবহার করে ছবির উৎস বা পূর্বের ব্যবহার অনুসন্ধান করুন।

  • ভিডিওর ক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড, শব্দ, ব্যক্তির কথা ও ঠোঁটের গতির মিল খুঁজুন।

  • ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (টুইটার)-এ ভিডিওর আপলোড তারিখ পরীক্ষা করুন — অনেক সময় পুরনো ভিডিওকে নতুন ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়।

৪. সোশ্যাল মিডিয়া যাচাই কৌশল ব্যবহার করুন

  • ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের সার্চ বক্সে কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে দেখুন ওই বিষয়ে আর কী তথ্য আছে।

  • সময় অনুযায়ী ফিল্টার করুন— ‘Latest’ বা ‘Most Recent’ ব্যবহার করে সাম্প্রতিক পোস্ট দেখুন।

  • ভেরিফায়েড পেজ বা প্রোফাইলের পোস্টকে বেশি গুরুত্ব দিন।

৫. তথ্য যাচাইয়ের জন্য ডিজিটাল টুল ব্যবহার করুন

  • Fact-checking ওয়েবসাইট (যেমন: BOOM, AFP Fact Check, BD Fact Check, PolitiFact ইত্যাদি) ব্যবহার করে দেখুন তথ্যটি ইতিমধ্যে যাচাই করা হয়েছে কি না।

  • দ্রুত প্রাথমিক যাচাইয়ের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন ChatGPT বা Google Gemini ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এদের উত্তর চূড়ান্ত সত্য হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয় — তথ্যটি পরবর্তীতে বিশ্বস্ত উৎসে মিলিয়ে নেওয়া উচিত।

৬. শেয়ার করার আগে ভাবুন

  • কোনো তথ্য, ছবি বা ভিডিও যাচাই না করে কখনোই শেয়ার করবেন না।

  • বিশেষ করে ফটোকাড বা উক্তি সংবলিত পোস্ট খুব সহজে গুজব ছড়ায় — এগুলো ভালোভাবে যাচাই করে তবেই শেয়ার করুন।

  • সন্দেহ থাকলে অপেক্ষা করুন, নিশ্চিত না হয়ে কিছুই শেয়ার করবেন না, চেক পয়েন্টকে জানান। 

    প্রয়োজনে আমাদের ইমেইল করুন এই ঠিকানায় verify@check-point.info

সচেতন নাগরিক হিসেবে সকলের দায়িত্ব হলো— সত্য যাচাই করা, গুজব প্রতিরোধ করা এবং একটি তথ্যনির্ভর ও সহনশীল সমাজ গড়ে তোলা।

চেক পয়েন্টের ফ্যাক্ট-চেকিং নীতিমালা

চেক পয়েন্ট তার ফ্যাক্ট-চেকিং কার্যক্রমে MIT Media Lab এবং First Draft’s Information Disorder Framework অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে। আমাদের মূল নীতিমালা এবং তার উদাহরণসমূহ:

১. দাবি শনাক্তকরণ (Claim Identification)

নীতি:
আমরা বিভ্রান্তিকর বা গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো শনাক্ত করি যেগুলো সমাজে ভুল তথ্য ছড়াতে পারে।

উদাহরণ:
কোনো ভাইরাল ফেসবুক পোস্টে বলা হচ্ছে "সরকার আজ বিকেলে পদত্যাগ করেছে।"
– আমরা এই ধরনের দাবি শনাক্ত করি এবং যাচাই করি।

২. যাচাইকরণ (Verification)

নীতি:
প্রমাণের ভিত্তিতে দাবি যাচাই করা হয়, অনুমানের ভিত্তিতে নয়।

উদাহরণ:
একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, "এই ছবিটি আজকের বন্যার দৃশ্য।"
– আমরা ছবির মেটাডেটা এবং রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে যাচাই করি ছবিটি আসলেই সাম্প্রতিক কিনা।

৩. প্রসঙ্গ নির্ধারণ (Contextualization)

নীতি:
তথ্য বা ছবি সঠিক প্রেক্ষাপটে আছে কিনা তা যাচাই করা হয়।

উদাহরণ:
কোনো ভিডিও দেখানো হচ্ছে "বাংলাদেশে দাঙ্গা চলছে", অথচ সেটি আসলে অন্য দেশের পুরনো ফুটেজ।
– আমরা ভিডিওর প্রকৃত সময় ও স্থান নিশ্চিত করি।

৪. তিন-স্তর বিশ্লেষণ (Triangulation)

নীতি:
একাধিক (কমপক্ষে তিনটি) নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য যাচাই করা হয়।

উদাহরণ:
কোনো রাজনীতিকের বক্তব্য যাচাই করতে আমরা জাতীয় সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও সরকারি নথি মিলিয়ে দেখি।

৫. প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা (Transparency)

নীতি:
যাচাইয়ের পদ্ধতি, তথ্যের উৎস এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাখ্যা প্রকাশ করা হয়।

উদাহরণ:
আমরা ফ্যাক্ট-চেক শেষে লেখায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করি — "এই তথ্য যাচাই করা হয়েছে Reuters, BBC এবং সরকারের প্রেস রিলিজের মাধ্যমে।"

৬. ভুল সংশোধন নীতিমালা (Correction Policy)

নীতি:
ভুল ধরা পড়লে দ্রুত সংশোধন ও আপডেট প্রদান করা হয়।

উদাহরণ:
প্রথমে যদি বলা হয় "এক্স কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য", পরে যদি প্রমাণিত হয় এটি ভুল, তখন আমরা সংশোধনী দিয়ে আপডেট করি: "পূর্বের রিপোর্ট সংশোধন করা হলো। এক্স কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল।"

৭. নৈতিক মানদণ্ড (Ethical Standards)

নীতি:
গোপনীয়তা রক্ষা এবং মানবিক সম্মান বজায় রেখে কাজ করা হয়।

উদাহরণ:
কোনো বিভ্রান্তিকর ঘটনার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ছবি বা নাম প্রকাশ না করে শুধু প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রকাশ করা হয়।

আমাদের প্রতিশ্রুতি

চেক পয়েন্ট সর্বদা সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিতে তথ্য যাচাই করে। প্রতিটি ফ্যাক্ট-চেকিংয়ে স্বচ্ছতা, নির্ভুলতা এবং নৈতিক মান বজায় রাখাই আমাদের অঙ্গীকার।